কিরণ দত্ত দ্য বং গাই জীবনী - The Bong Guy (Kiran Dutta) Biography in Bengali

The Bong Guy Kiran Dutta Biography in Bengali

কিরণ দত্ত, যাকে আমরা সবাই ‘দ্য বং গাই’ নামে চিনি, আজকের দিনে বাংলার ইউটিউব জগতের অন্যতম প্রধান মুখ। কিন্তু এই খ্যাতি আর জনপ্রিয়তা এক দিনে আসেনি। কিরণের যাত্রাপথটা ছিল চড়াই-উতরাইয়ে ভরা। তার সাফল্যের পেছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম, ব্যর্থতার বিরুদ্ধে লড়াই, এবং একটা অদম্য ইচ্ছাশক্তি যা তাকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এই গল্পটা শুধুমাত্র একজন ইউটিউবারের নয়, বরং একজন সাধারণ ছেলের অদম্য ইচ্ছাশক্তির গল্প।

জন্ম ও শৈশব

কিরণ দত্তের জন্ম ১৯৯৫ সালের ১৫ জুলাই, ভারতের রাজস্থানের জয়সলমীরে। তার বাবা কালীপদ দত্ত তখন ইন্ডিয়ান পুলিশ ফোর্সে কর্মরত ছিলেন, যার ফলে পরিবারকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হতো। কিরণের মা ডালি দত্ত একজন গৃহবধূ, এবং তার বড় ভাইও রয়েছে। ছোটবেলা থেকেই কিরণ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার পরিবারের ইচ্ছা ছিল, ছেলে বড় হয়ে কোনো ভালো চাকরি করে সংসার সামলাবে। স্কুল জীবনে কিরণ তার ব্লক এলাকায় প্রথম স্থান অধিকার করে, এবং উচ্চমাধ্যমিকে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। কিন্তু, ভাগ্য যেন তাকে অন্য পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কিরণ যখন জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারল না, তখন সে এক বছর বিরতি নিয়ে আবার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু দ্বিতীয়বারেও সাফল্য না পেয়ে, বাধ্য হয়ে নেতাজি সুভাষ কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভর্তি হতে হয়। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রথম বর্ষে অঙ্কে ফেল করে কিরণ আরও মানসিক চাপে পড়ে যায়। কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। পরবর্তী বছরগুলোতে সে কঠোর পরিশ্রম করে ৭০ শতাংশ নম্বর অর্জনের চেষ্টা করে, কিন্তু তার মনের ভেতরে চলছিল অন্য কিছু।

ইউটিউবে যাত্রা শুরু

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অংকে ফেল করার পর থেকেই কিরণের মনে একটা নতুন ভাবনা জাগে—কিছু একটা আলাদা করার। সে তখনকার সময়ের জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেল যেমন ‘টিভিএফ’ বা ‘বিবি কি ভাইনস’ দেখে অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায় এমন কিছু করার কেউই ভাবেনি তখন। ২০১৫ সালে কিরণ তার নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘দ্য বং গাই’ শুরু করে। কিন্তু প্রথম দিকে তেমন সাড়া পায়নি। তার ভিডিওগুলোতে মাত্র ২০০-৩০০ ভিউ আসত। 

কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। কিছুদিনের জন্য ভিডিও বানানো বন্ধ করে দিয়ে, সে গান গাওয়ার দিকে মনোযোগ দেয়। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল। সে নিজের গিটার বাজিয়ে গান রেকর্ড করত এবং ফেসবুক পেজে আপলোড করত। তবে ২০১৭ সালে আবার ইউটিউবে ফিরেই কিরণের জীবনে বড় পরিবর্তন আসে। তার কনটেন্টগুলো ক্রমেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে, এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তার সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যায়।

‘এ কেমন সিনেমা’ এবং জনপ্রিয়তা

২০১৭ সালের ‘এ কেমন সিনেমা’ সিরিজটি কিরণ দত্তের জনপ্রিয়তার মূল কারণ হয়ে ওঠে। তার এই মজার রিভিউ ভিডিওগুলোতে বাংলা এবং হিন্দি সিনেমার উপর ভিত্তি করে হাস্যরসাত্মক কন্টেন্ট তৈরি করা হতো, যা মানুষকে খুবই আনন্দ দিত। তার অভিনব উপস্থাপনা, স্মার্ট ডায়ালগ এবং ভিন্নধর্মী কন্টেন্ট দর্শকদের মন জয় করতে শুরু করে। 

এরপর কিরণ একের পর এক মজার ভিডিও বানিয়ে চলতে থাকে, এবং তার ইউটিউব চ্যানেল ক্রমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছায়। তার ভিডিওগুলো শুধু বাংলাতেই নয়, সারা ভারতের মানুষের কাছেও পৌঁছে যায়। বলিউডের তারকা আলিয়া ভাট, বরুণ ধাওয়ান, দেব প্রমুখ অভিনেতারা পর্যন্ত তার চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের সিনেমা প্রমোট করেছিলেন। 

সঙ্গীত ও সিনেমায় কিরণ

কিরণ শুধু ইউটিউবারই নয়, তিনি একজন গায়ক এবং অভিনেতাও। তার নিজের তৈরি গান ‘ওপেক্ষা’ এবং ‘লকডাউন সং’ অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া, কিরণ অভিনয় জগতে পা রেখেছেন ‘কলকাতা চলন্তিকা’ নামক বাংলা সিনেমার মাধ্যমে। এই সিনেমাটি ২০২২ সালে মুক্তি পেয়েছে, এবং এখানে তিনি ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করেছেন।

বড় বড় ব্র্যান্ডের সাথে কাজ

কিরণের জনপ্রিয়তার দরুন তিনি বিভিন্ন নামকরা ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ইউটিউব, গুগল, নেটফ্লিক্স, মেটা, স্যামসাং, থামস আপ, জিওসিনেমা, অ্যামাজন ইন্ডিয়া, আইএসএল, কেএফসি, কোক স্টুডিওর মতো বড় ব্র্যান্ডের সাথে কাজ করেছেন। এইসব ব্র্যান্ডের সাথে তার কোলাবরেশন তার ক্যারিয়ারকে আরও উঁচুতে নিয়ে গিয়েছে। কিরণ এখন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ডিজিটাল কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের মধ্যে একজন।

বিতর্ক এবং সমালোচনা

ইউটিউব জগতে কিরণের সাফল্যের পাশাপাশি তাকে বেশ কিছু বিতর্কেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল টলিউড অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরার সাথে হওয়া বিতর্ক। অঙ্কুশ একবার মজা করে বলেছিলেন যে তিনি হলিউডের সিনেমার রিমেক করতে চান না, এবং এই বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে কিরণ একটি মিম বানিয়ে শেয়ার করেন, যা ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর অঙ্কুশ টুইটারে এর উত্তর দেন, এবং কিছুদিন পরে কিরণ এই ঘটনার উপর একটি ভিডিও বানিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেন।

কিছুদিন আগে আরও একটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিরণ। দাদাগিরিতে অংশগ্রহণ করা নিয়ে মৃন্ময়ের সাথে তার তুমুল ঝগড়া হয়, এবং দুজনেই একের পর এক আক্রমণাত্মক ভিডিও পোস্ট করেন। তবে এসব বিতর্ক কখনোই তার জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি, বরং তার সমর্থকরা তাকে আরও ভালোবাসা দিয়েছে।

ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে গোপনীয়তা

কিরণ তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বরাবরই গোপনীয়তা বজায় রাখেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সামাজিক মাধ্যমে মানুষ সুযোগ পেলেই অন্যদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁত খুঁজে বেড়ায়। তাই তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন সবার সামনে তুলে ধরে তার প্রিয় মানুষটিকে কষ্ট দিতে চান না। তবে তিনি বলেন, সঠিক সময়ে সবাইকে সবকিছু জানানো হবে।

ফোর্বস ম্যাগাজিনে স্থান

২০২৪ সাল কিরণ দত্তের ক্যারিয়ারে এক নতুন পালক যোগ করেছে। কিরণ দত্তের নাম আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ফোর্বস ম্যাগাজিনের সেরা ১০০ ডিজিটাল স্টারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এবং তিনি ১০ নম্বর স্থানে রয়েছেন। এটি কেবল বাংলার জন্যই নয়, পুরো ভারতের জন্যই একটি বড় সম্মানের বিষয়। কিরণ নিজেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই খবরটি শেয়ার করেছেন, যা তার ভক্তদের জন্যও ছিল এক আনন্দঘন মুহূর্ত।

এই সম্মান প্রমাণ করে যে, কিরণ শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ নন, তার প্রতিভা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। ফোর্বসের মতো একটি আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে স্থান পাওয়া কিরণের ইউটিউব এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তার কাজের প্রতি বিশ্বের স্বীকৃতির প্রতিফলন। এই অর্জন শুধু কিরণ দত্তকেই নয়, বাংলা ভাষার ডিজিটাল কন্টেন্ট নির্মাতাদের জন্যও এক বিশাল অনুপ্রেরণা।

সাফল্যের শীর্ষভাগ

কিরণ দত্ত বর্তমানে বাংলা তথা ভারতের একজন সফল ইউটিউবার, গায়ক, এবং অভিনেতা। তার ইনস্টাগ্রামে ১.২ মিলিয়ন ফলোয়ার রয়েছে, এবং ইউটিউবে তার সাবস্ক্রাইবার ৪০ লক্ষের বেশি। তিনি বাংলার প্রথম ইউটিউবার যিনি "অল ইন্ডিয়া ইউটিউব কোলাবরেশন" এর ডাক পেয়েছিলেন এবং সেখানে ভারতের বড় বড় ইউটিউবারদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। তার এই যাত্রাপথ আমাদের শিখিয়ে দেয় যে কঠোর পরিশ্রম এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সবকিছু সম্ভব।

উপসংহার

কিরণ দত্তের জীবনগল্পটা আমাদের শেখায় যে, জীবনের পথে ব্যর্থতা আসতেই পারে, কিন্তু কখনো হাল ছাড়লে চলবে না। তিনি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সফল না হলেও, ইউটিউবের মাধ্যমে নিজের জীবনে সফলতা অর্জন করেছেন। তার এই যাত্রা শুধু কিরণের নয়, এটি বাংলার গর্বের যাত্রা, যা ভবিষ্যত প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
Next Post
No Comment
Add Comment
comment url